গোলাপের অপেক্ষায়

মেয়েটির নাম এঞ্জেলা। দেখতে মোটামুটি সুন্দরী বটে। শখে ও পেশায় চিত্র শিল্পী। ঢাকার চারুকলা থেকে পাশ করে এখন রাঙ্গামাটির তার নিজ গ্রামে থাকে ও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পর্যটকদের ছবি আঁকে।

রাজিব ঢাকাতে একটি পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে সোশ্যাল সায়েন্সএ মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ার এর ছাত্র। সে একটা থিসিস করার জন্য রাঙ্গামাটি গিয়েছে। জীবনের প্রথম ঢাকার বাইরে কোথাও যাওয়া তার মধ্যে থাকতে হবে প্রায় ১ মাস। সে তার এক দূর সম্পর্কের মামার বাড়ি উঠেছে। মামা তাকে বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসায় নিয়ে গেল, অনেক লং জার্নি তাই বাসায় গিয়ে কার সাথে ঠিক মত কথা না বলেই গোসল করে শুয়ে পড়লো। ঘুম থেকে উঠে দুপুরের খাবার খেয়ে পরে বিকেলের দিকে বাইরে ঘুরতে গিয়ে প্রথম দেখাতেই রাঙ্গামাটির প্রেমে পরে গেল। অনেকক্ষণ হাটাহাটি করে এখন বাসায় আসবে এমন সময়ে দেখে একটি মেয়ে ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে কি যেন খুজছে। সে দূর থেকে লক্ষ্য করলো কিন্তু কাছে গেল না। মেয়েটিও অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে চলে গেল।

মেয়েটি চলে যাওয়ার পর রাজিব ওখানে গেল এবং কিছুক্ষণ আশেপাশে তাকানোর পর একটা ব্যাগ পেল যার মধ্যে ছবি আঁকার রং, তুলি সহ যাবতীয় সরঞ্জাম আছে। রাজিব পরে মেয়েটিকে দৌড়ে ধড়ার চেস্টা করলো কিন্তু হঠাত কি যেন মাথায় আসলো যে সে মেয়েটির বাসা পর্যন্ত গেল ঠিকই র দেখা করলো না। তখন ঘড়িতে ৫ টা বাজে। সে এখন তার বাসায় ফিরে যাবে। বাসায় এসে সে আর সারা রাত ঘুমাতে পারলো না। সারা রাত শুধু ঐ মেয়েটি তার মাথায় ঘুরাঘুরি করলো।

এঞ্জেলা প্রতিদিন সকালে তার কাজে ছবি আঁকতে বের হয় এবং বাসায় আসতে আসতে তার প্রায় ৫টা বাজে। প্রতি দিনের মত আজকেও সে ছবি আঁকতে বের হয়েছে কিন্তু বাসায় ফিরে সে একটু অবাক হয়। কে যেন তার ঘরের দরজার সামনে ৫টা গোলাপ রেখে গেছে। সে অনেক খোজাখুজি করেও কোন মানুষ পেল না। আজকে সে সারারাত শুধু ভাবল কে তাকে ফুল দিতে পারে। এভাবে কখন যে সে ঘুমিয়ে গেছে সে জানে না, হঠাত অ্যালার্ম ঘড়ির আওয়াজে তার ঘুম ভাঙ্গে। আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে তাকে খুব তারাতারি তৈরি হয়ে কাজে যেতে হবে। এখন অফ সিজন, খুব কম পর্যটক আসে তাই কাজের প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। গতকালের মত আজকেও সে বাসায় এসে দেখে তার দরজার সামনে ৫ টা গোলাপ রাখা। আজকে সে খুজে বের করবেই লোকটিকে এমন পন করে অনেক খোঁজাখুঁজি করলো কিন্তু আজকেও সে তাকে পেল না। আজকেও ঠিক মত ঘুম হল না তার। এভাবেই কেটে গেল প্রায় এক সপ্তাহ।

রাজিব রাঙ্গামাটি এসেছে প্রায় ৭ দিন। এর মধ্যেই সে আশেপাশের প্রায় সব রাস্তা, হোটেল  সহ যাবতীয় জায়গা চিনে ফেলেছে। তবে আজকে সে একটু দূরে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতেছিল। যেতে যেতে কি যেন দেখে হঠাত করে সে থেমে গেল। হাত দিয়ে কিছুক্ষন চোখ মুছল কিন্তু নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। একটু সামনে গেল, না এইতো সেই মেয়ে যার কথা ভেবে আমি প্রতি রাতে ঠিক মত ঘুমাতে পারি না। দূর থেকে সে দেখতে থাকল যে মেয়েটি কি করে। তখন এঞ্জেলা একটি ফরেইনার বাচ্চা মেয়ের স্কেচ করতেছিল। রাজিব ভাবতেছে আজকে কি সামনে যাব? একপা আগায় আবার পিছে যায়। না আজকে যাওয়া যাবে না। কাল আবার আসব।

দিনটি ছিল রবিবার। রাজিব ঠিক ৩ টার মধ্যে তার কাজ শেষ করে ছবি আঁকাবে বলে ঐখানেই গেল যেখানে গতকাল এঞ্জেলা কে দেখেছিল। গিয়ে দেখে আজকে লোকজন খুব কম। এঞ্জেলার সামনে যেতেই এঞ্জেলা তাকে জিজ্ঞেস করলো ছবি আকবে কিনা? রাজিবের মুখ দিয়ে কথা বের হয় না।

রাজিবঃ হুম, আ, উ বলে বললো হ্যাঁ আমি একটা স্কেচ করাতে চাই। রাজিবের ইতস্তত ভাব দেখে এঞ্জেলা ভাবল কিছু কথা বলে তাকে রিলাক্স করা যায় কিনা। সে বলল আমি এঞ্জেলা।
রাজিবঃ আবার আমতা আমতা কন্ঠে, আমি রাজিব।
এঞ্জেলাঃ আপনি এখানে বেরাতে এসেছেন?
রাজিবঃ আমি ঢাকা থেকে থিসিস করতে এসেছি।
এঞ্জেলাঃ আমাদের রাঙ্গামাটি কেমন লাগছে?
রাজিবঃ খুব সুন্দর।
এখন তাকে একটু শান্ত মনে হচ্ছে তাই এঞ্জেলা তাকে বসতে বলল ও আঁকা শুরু করলো। অর্ধেক আঁকা হয়েছে এমন সময়ে রাজিব বলে উঠে আজকে আমার কাজ আছে, কিছু টাকা বের করে এটা রাখেন আমি কালকে এসে বাকিটুকু করিয়ে নিয়ে যাব বলে কোন উত্তরের সময় না দিয়েই দৌড়ে চলে গেল।

আজকে অনেক বৃষ্টি। তবুও রাজিব যাবে এঞ্জেলার কাছে। ছবি আঁকার জন্যই হোক আর যে কারনেই হোক, এঞ্জেলাকে তার দেখতেই হবে। সে যাচ্ছে এমন সময়ে হঠাত খবর পায় তার মামাতো ভাই এক্সিডেন্ট করেছে, হাসপাতালে আছে ও রক্ত লাগবে। তার রক্তের সাথে মিল থাকায় সে গেল রক্ত দিতে আর ঐ দিকে এঞ্জেলা বৃষ্টি তে ভিজে ভিজে অপেক্ষা করছে তার জন্য। আজকে তো রাজিবের ঐখানে যাওয়া হলই না এমনকি আরও তিন দিন সে যেতে পারল না।

তিন দিন পর রাজিব গেল ছবি আঁকাতে। গিয়ে জিজ্ঞেস করে আপনাকে অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত। এঞ্জেলা তাকে বসতে বলল ও আঁকা শুরু করলো। আঁকার মধ্যেই রাজিব তাকে জিজ্ঞেস করলো আমি ঐ বৃষ্টি তে আমার জন্য অপেক্ষা করেছেন? এঞ্জেলা বলে না। আমার তো আপনার কথা মনেই ছিল না। একটু পরেই তার ছবি আঁকা শেষ ও রাজিব কে দিয়ে দিল। রাজিব ছবিটা অনেকক্ষণ দেখা দেখি করতেছিল। আসলে সে আরও কিছু সময় এঞ্জেলার সাথে থাকার জন্য এমনটা করতেছিল কিন্তু এঞ্জেলা ভাবলও হয়তো তার আঁকা ছবি রাজিবের পছন্দ হয়নি। তাই সে তাকে বলল আপনার যদি পছন্দ না হয়ে থাকে তাহলে আপনাকে একটা অয়েল-পেইন্ট করে দিব। রাজিব তো এমন একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। সে এক কথায় রাজি। কিন্তু আজকে না বলে আবার কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল।

আগের দিনের কথা অনুযায়ী রাজিব অয়েল পেইন্ট করাতে চলে গেল। রাজিবের গত দিন গুলোর আচরন এঞ্জেলার কাছে রহস্যময় মনে হওয়ায় আজকে সে ছবি আঁকার ফাকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করলো। রাজিব ও সব কথার উত্তর দিল। রাজিবের কথা বলার ভাব-ভঙ্গি ও মার্জিত রুপ দেখে এঞ্জেলার মনের সব সন্দেহ দূর হয় এবং তার ভাল লাগে। আজকে ছবি আঁকা শেষে রাজিব তার ছবি আঁকার অনেক প্রশংসা করলো ও এঞ্জেলা কে বলল আমি আপনার ছবি আঁকা দেখতে প্রতি দিন আসব। এঞ্জেলা অসম্মতি জানালো না। এভাবে প্রতি দিন আসতে আসতে তারা দুই জন খুব ভাল বন্ধু হয়ে গেল। রাজিব প্রতিদিন এঞ্জেলার সাথে গল্প করে। একে অপরকে জানার চেষ্টা করে, চাওয়া-পাওয়া, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা বলে।  রাজিব প্রতিদিন তাকে বাসার কাছাকাছি এগিয়ে দিয়ে আসে। এঞ্জেলা রাজিবের কোন ব্যাপারে অসম্মতি জানায় না। তারা খুব অল্প সময়ে অনেক ভাল বন্ধু হয়ে গেল।

এদিকে প্রতিদিন বাসায় গিয়েই এঞ্জেলা ৫ টি করে গোলাপ ফুল দেখতে পায় তার দরজার সামনে। বেপারটা তার কাছে ভাল লাগে। কেউ একজন তো আছে যে দুর থেকে তার কথা ভাবে। এখন সে মন থেকে আশা ও করে যে বাসায় গিয়ে দরজা থেকে ফুল নিয়ে ঘরে রাখবে। ফুল পেয়ে সে অনেক খুশি হয়। হঠাত একদিন বাসায় এসে দেখে দরজার সামনে কোন ফুল নেই। তার কাছে একটু খারাপ লাগে। একবার ভাবে এটা আর এমন কি? অপরিচিত কেউ একজন ফুল দিত এখন আর তার ভাল লাগে না তাই দেয় নাই। মনকে যতই বুঝানো হোকনা কেন, মন কিছুতেই মানতে চায় না। প্রতিদিনের মত আজকেও সে ঠিক মত ঘুমাতে পারলো না, তবে আজকে একটাই কথা তার মাথায় ঘুরছে যে কেন লোকটি ফুল দিল না? তার কি কোন সমস্যা হয়েছে? এভাবে কয়েকটা দিন চলে গেল, এখন আর কেউ ফুল রেখে যায় না। এঞ্জেলা তার জীবনে একটা শূন্যতা অনুভব করে। সে এক অন্য রকম মানুসিক অশান্তি অনুভব করে। একটা কথা তার মাথায় ঘুরাঘুরি করছে। সে বুঝতে পারছে না এটা কেমন অনুভব? সে একজন অপরিচিত মানুষকে নিয়ে এত কেন ভাবছে? এরই মধ্যে এঞ্জেলা কিছুদিনের জন্য ব্যাস্ত হয়ে পরে। সামনে তার এক্সিবিসন। এতে রাজিব তাকে অনেক সাহায্য করে। বেশ কিছুদিনের ব্যাস্ততায় ও এক্সিবিসনের শেষে সে খুব ক্লান্ত অনুভব করে।

সে সিদ্ধান্ত নিল কিছু দিন ছবি আঁকা থেকে নিজেকে দূরে রাখবে। সারাদিন সে বাসায়। ঐ দিকে দুপুর সময়ে রাজিব গিয়ে এঞ্জেলাকে না পেয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে এল। হঠাত এঞ্জেলা একটা শব্দ পেল। সে ভাবল এই বুঝি কেউ ফুল দিতে এল। উৎসাহের সাথে সে দৌড়ে গেল কিন্তু দেখে রাজিব দাড়িয়ে আছে। কেন আজকে বের হয়নি একথা জিজ্ঞেস করায় সে রাজিবকে উত্তরে বলল তার খুব ক্লান্ত লাগছে, কিছু দিনের জন্য বিশ্রাম নিতে চায়। রাজিব অনেক কথা জিজ্ঞেস করলো কিন্তু সে সব কথা এড়িয়ে গেল। ঐ দিনের মত কথা শেষ করে রাজিব চলে এলো।

এভাবেই আরও কয়েকটা দিন কেটে গেল। এদিকে এঞ্জেলা এখন ফুল দেয়া অপরিচত লোকটির শূন্যতা অনুভব করে প্রায়ই মন খারাপ করে বসে থাকে। ঘর থেকে তেমন বের ও হয় না। রাজিব আবারো তার বাসায় গেল। এঞ্জেলা তার জন্য কফি নিয়ে এলো তখন প্রায় বিকেল ৫ টা বাজে। রাজিব লক্ষ্য করে কফি আনতে আনতে সে শুধু দরজার দিকে তাকাচ্ছে। রাজিব জিজ্ঞেস করলো কারো জন্য কি অপেক্ষা করছ?

এঞ্জেলাঃ (মনে মনে- অপেক্ষা! সে তো আমার জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। দাদা ভাই বলেছিল একদিন আমার মা-বাবা আসবে কিন্তু আজও আসেনি। অপেক্ষা! তার জন্য অপেক্ষায় থাকি যাকে আমি কখনও দেখিনি। সে কখনও ফিরে আসবে কিনা জানি না তারপরেও আমি অপেক্ষায়! লোকটি আমাকে প্রতিদিন ফুল দিত অথচ কখনও একটিবারের জন্য ধন্যবাদ ও বলতে পারিনি) নাহ! আচ্ছা বাদ দাও। তুমি কি রবীন্দ্র সঙ্গীত পছমদ কর?
রাজিবঃ হ্যাঁ। যখন বাসায় থাকি তখন রবীন্দ্র সঙ্গীত ই শুনি।
এঞ্জেলাঃ মৃদু আওয়াজে একটি গান বাজালো (আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইল না কেহ। সে তো এলো না যারে সঁপিলাম এই প্রান মন দেহ।) এই নাও কফি। এঞ্জেলা কিছুটা আবেগ প্রবন হয়ে বলে রাজিব... তোমার কাছে আমি অনেক ঋণী। তুমি তখন আমার বন্ধু হলে যখন আমি খুব একা। তুমি এভাবে চিরদিন আমার বন্ধু হয়ে থাকবে?
রাজিবঃ একথা কেন বলছ? আমি তোমাকে ছেড়ে কখনও যাব না। বন্ধুত্তের বাঁধন সহজে ছিরে যাওয়া যায় না
এঞ্জেলাঃ ভয় হয়! আমি সারা জীবন একা থেকে অবভ্যস্থ। কোন বাঁধন আমার জীবনে কাউকে বেধে রাখতে পারেনি।

কিছুক্ষণ পর রাজিব চলে গেল। এভাবে কয়েক সপ্তাহ চলে গেল। এরই মধ্যে এঞ্জেলার মনের ভিতরের রাজিবের জন্য খানিকটা জায়গা তৈরী হয়ে গেছে। সে এখন রাজিবের প্রতি দুর্বল হতে শুরু করেছে যা কিনা সে কখনও চাইনি। রাজিবকে এঞ্জেলা শুধুই বন্ধু হিসেবে পেতে চায় কিন্তু মনের সাথে পেরে ওঠার সাধ্য কার আছে? এভাবে ভেবে সে সিদ্ধান্ত নিল রাজিবের কাছ থেকে দূরে চলে যাবে। সে ঢাকা চলে যাবে।

রাঙ্গামাটি তে থাকলে তার কিছুই করা হবে না। দিনের কিছুটা সময় তার রাজিবের কথা ভেবে কাটে আবার কখনও সে অপরিচিত লোকটি শূন্যতা অনুভব করে। সে এমন এক দোটানায় পড়েছে যা থেকে বের হওয়া হয়তো তার পক্ষে সম্ভব না। রাজিবকে না জানিয়ে সে ঢাকার টিকেট সহ সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে বের হবে এমন সময়ে দরজা খুলে দেখে রাজিব ফুল নিয়ে দাড়িয়ে আছে। রাজিব কে দেখে তার চোখ ফুলের দিকে চলে যায় ও নিজের অজান্তেই গুনে ফেলে ও দেখে ঠিক ৫ টা গোলাপ ফুল ই তার হাতে। তা দেখে সে রাজিবকে জরিয়ে ধরে ও অভিমানি কন্ঠে জিজ্ঞেস করে এত দিন বলনি কেন? রাজিব চুপ করে থাকে।


Comments

Popular Post

তুমি আমার মানে, পুরোটাই আমার

মুক্ত করে দিব পাখির মত

মা, মামুনি, আম্মু, আম্মা, মম